হাওজা নিউজ এজেন্সি রিপোর্ট অনুযায়ী, পশ্চিমবঙ্গের উত্তর ২৪পরগনা জেলার অন্তর্গত রাজাপুর গ্রামের মসজিদের পেশ ইমাম হুজ্জাতুল ইসলাম মাওলানা হাসান আলী সাহেব হজরত ইমাম মাহদী (আ.) সম্পর্কে সুন্দর আলোচনা করেছেন।
ইমাম মাহদী (আ.)-এর গাইবাত আল্লাহর এক বিশেষ হিকমতের অংশ। এটি শুধু তাঁর রক্ষা ও সংরক্ষণের জন্য নয়, বরং এটি মানবজাতির জন্য একটি পরীক্ষা এবং আত্মশুদ্ধির সুযোগ। তাঁর গাইবাতের সময়কাল আমাদের জন্য অপেক্ষা এবং প্রস্তুতির সময়, যাতে আমরা তাঁর আবির্ভাবের জন্য যোগ্য হয়ে উঠতে পারি। আল্লাহর ইচ্ছা অনুযায়ী একদিন তিনি প্রকাশিত হবেন এবং বিশ্বে ন্যায়বিচার ও শান্তি প্রতিষ্ঠা করবেন।
গাইবের সংজ্ঞা
গাইব (غيبة) আরবি শব্দ, যার অর্থ হলো "অদৃশ্য থাকা" বা "লোকচক্ষুর আড়ালে থাকা"। ইসলামী পরিভাষায়, এটি এমন এক অবস্থাকে বোঝায় যেখানে একজন ব্যক্তি শারীরিকভাবে জীবিত থাকলেও সাধারণ মানুষের দৃষ্টির অন্তরালে থাকেন এবং সরাসরি জনসাধারণের সাথে যোগাযোগ করেন না।
ইমাম মাহদী (আ.)-এর গাইব থাকার কারণ
ইমাম মাহদী (আ.) ইসলামের দ্বাদশতম ইমাম, যিনি নবী মুহাম্মাদ (সা.)-এর বংশধর এবং হযরত ফাতিমা (আ.)-এর সন্তান। ইসলামী বিশ্বাস অনুযায়ী, তিনি দীর্ঘ সময় ধরে গাইব অবস্থায় আছেন এবং নির্দিষ্ট সময়ে প্রকাশিত হবেন। তাঁর গাইবাতের পেছনে কিছু গুরুত্বপূর্ণ কারণ রয়েছে:
আল্লাহর পরিকল্পনা ও পরীক্ষা
গাইবাতের মূল কারণ হলো আল্লাহর ইচ্ছা ও পরিকল্পনা।
এটি মানুষের জন্য একটি পরীক্ষা, যাতে তারা তাদের ঈমান বজায় রাখে এবং সত্যের অনুসরণে অবিচল থাকে।
অত্যাচারী শাসকদের ষড়যন্ত্র থেকে সুরক্ষা
ইতিহাসে দেখা যায়, পূর্ববর্তী ইমামদের অনেকেই অত্যাচারী শাসকদের দ্বারা নির্যাতিত বা শহীদ হয়েছেন।
ইমাম মাহদী (আ.)-এর গাইব থাকার অন্যতম কারণ হলো তাঁকে শত্রুদের হাত থেকে রক্ষা করা, যাতে তিনি ভবিষ্যতে আল্লাহর নির্ধারিত সময়ে প্রকাশিত হয়ে মানবজাতির মুক্তির জন্য কাজ করতে পারেন।
সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার উপযুক্ত সময় আসার অপেক্ষা
ইমাম মাহদী (আ.)-এর আবির্ভাব তখনই ঘটবে যখন পৃথিবী চূড়ান্তভাবে অন্যায়, দুর্নীতি ও অশান্তিতে পরিপূর্ণ হয়ে যাবে।
মানুষের প্রস্তুতি ও আল্লাহর নির্ধারিত সময়ের আগমনের অপেক্ষায় তিনি গাইব রয়েছেন।
সমাজকে আত্মশুদ্ধি ও প্রস্তুতির সুযোগ দেওয়া
গাইবাতের সময়কাল মুসলমানদের জন্য একটি আত্মশুদ্ধির সময়, যাতে তারা নিজেদের শুদ্ধ করে এবং ইমামের আগমনের জন্য প্রস্তুত হয়।
এটি ইমামের সত্য অনুসারীদের পরীক্ষা করার একটি উপায়।
ইমামের অলৌকিক দীর্ঘায়ু নিশ্চিত করা
ইসলামি বিশ্বাস অনুসারে, ইমাম মাহদী (আ.) দীর্ঘায়ু পাবেন এবং তাঁর গাইব থাকার ফলে তিনি সময়ের সীমাবদ্ধতা থেকে মুক্ত থাকবেন।
এটি নিশ্চিত করবে যে তিনি তাঁর দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করতে পারেন যখন আল্লাহ তাঁকে প্রকাশ করবেন।
গাইবাতের দুটি ধাপ
১. ছোট গাইবাত (গাইবাত-ই সুগরা - غيبة الصغرى)
এই সময়কাল ৮৭৪ খ্রিস্টাব্দ থেকে ৯৪১ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত স্থায়ী ছিল।
ইমাম মাহদী (আ.) সরাসরি উপস্থিত না থাকলেও নির্দিষ্ট প্রতিনিধি বা "নায়েব" (বিশেষ দূত) এর মাধ্যমে শিয়া মুসলমানদের সাথে যোগাযোগ করতেন।
এই চারজন বিশেষ প্রতিনিধি ছিলেন:
উসমান ইবন সাঈদ আমরী, মোহাম্মদ ইবন উসমান, হোসেইন ইবন রুহ, আলী ইবন মুহাম্মাদ সামরী।
২. বড় গাইবাত (গাইবাত-ই কুবরা - غيبة الكبرى)
৯৪১ খ্রিস্টাব্দ থেকে শুরু হয়ে এখনো চলছে।
এই পর্যায়ে ইমাম মাহদী (আ.) কোনো নির্দিষ্ট প্রতিনিধির মাধ্যমে সরাসরি যোগাযোগ করেন না, তবে তাঁর বার্তাগুলো ইসলামিক আলেম ও ধর্মীয় গাইডদের মাধ্যমে প্রচারিত হয়।
এই গাইবাত চলতে থাকবে যতক্ষণ না আল্লাহর হুকুমে তিনি প্রকাশিত হন।
গাইবাতের যুগে আমাদের করণীয়
- ধৈর্য ও ঈমান বজায় রাখা: ইমামের প্রতি বিশ্বাস রাখা এবং তাঁর আগমনের জন্য অপেক্ষা করা।
- আত্মশুদ্ধি: নিজেদের নৈতিকভাবে শক্তিশালী করা এবং ইসলামিক জ্ঞানে সমৃদ্ধ হওয়া।
- ন্যায়বিচারের পক্ষে থাকা: সমাজে সত্য ও ইনসাফ প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রাখা।
- দোয়া ও ইমামের জন্য প্রার্থনা করা: বিশেষত দুয়া-ই আহদ, দুয়া-ই নুদবা ইত্যাদি পাঠ করা।
- ইমামের বার্তা প্রচার করা: সমাজে ইমামের শিক্ষা ও আদর্শ ছড়িয়ে দেওয়া।
লেখা: হুজ্জাতুল ইসলাম মাওলানা হাসান আলী কিবলা
আপনার কমেন্ট